‘দিনবদলের বইছে হাওয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমাদের প্রথম চাওয়া’
স্থপতি ইয়াফেস ওসমান, মাননীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রীর উদ্ধৃত পঙ্ক্তির লাইনকে স্মরণ করলে মনে পড়ে সরকার তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, ডটার অব পিচ, দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ২০০৯-১০ সাল নাগাদ দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের ওপর গুরুত্ব আরোপ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ : ভিশন-২০২১’ ঘোষণার কথা।
যখন সারাদেশে সীমাহীন বিদ্যুৎ সংকট চলছিল এবং বিদ্যুৎ ঘাটতি পূরণের অসম্ভব চ্যালেঞ্জকে মাথায় রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এই সুদূরপ্রসারী চিন্তা, স্বপ্ন ও ঘোষণাকে সমাজের সুশীল নামধারী কিছু তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সেদিন কটাক্ষ করেছিল। সমালোচনামুখর সেইসব কুশীলবদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যকে পেছনে ফেলে বিদ্যুতের ঘাটতিকে জয় ও উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরের ফলে বাংলাদেশ আজ নি¤œ মধ্যবিত্ত দেশের তালিকায় জায়গা করে নিতে সমর্থ হয়েছে। তাই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবিধাভোগী প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরে আপামর মানুষের কণ্ঠে আজ ধ্বনিত হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা এবং দেশরতœ জননেত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ কালের আবর্তে আজ স্বপ্ন নয় বাস্তবতা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একটি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে সরকার যে ‘রূপকল্প ২০২১’ ঘোষণা করেছিল সেই ঘোষণার আলোকে ইতোমধ্যে জেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা, মোবাইল মানি ট্রান্সফার, বিমানের টিকিট, ই-টেন্ডারিংসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, বাণিজ্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। তা সত্ত্বেও জনগণের দোরগোড়ায় তথ্যপ্রযুক্তির সেবা তথা ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল পৌঁছে দিতে আমাদের আন্তরিক প্রয়াস নিতে হবে। আজ আর কেউ প্রশ্ন করে না ডিজিটাল বাংলাদেশ কি এবং কেন কারণ ডিজিটাল বাংলাদেশ হলো তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ বাংলাদেশ যেখানে আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সকল সুবিধা ব্যবহার করে অল্প সময়ে, কম পরিশ্রমে, স্বল্প ব্যয়ে, মানুষের দোরগোড়ায় তথ্য ও সেবা পৌঁছানোর নিশ্চয়তা দান। ডিজিটাল বাংলাদেশের ধারণাটি Knowledge based society-কে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত। Information and Communication Technology (ICT হচ্ছে এই GB Knowledge based society তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে বুঝায় আইসিটি বা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে e-Governance প্রতিষ্ঠিত করা ও সেবা প্রদান করা।
যদি বাংলাদেশকে ডিজিটাল করা সম্ভব হয় তা হলে এটা একটি e-state-এ পরিণত হবে যেখানে থাকবেÑ governance, e-banking, e-commerce, e-learning, e-agriculture, e-health এবং আরও অনেক কিছু।
ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য
* স্বচ্ছতা, * জবাবদিহিতামূলক সরকার, * দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন, * দ্রুত সেবা, * কম খরচ, * যুগোপযোগী মাধ্যম, * টেকসই অর্থনীতি
সরকার কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন ডিজিটাল পদক্ষেপ
* মন্ত্রণালয়ে ই-সেবা চালু, * থ্রিজি প্রযুক্তির মোবাইল পরিসেবা চালু, * জাতীয় ই-তথ্যকোষের আনুষ্ঠানিক যাত্রা, * তিন বছরের কর অবকাস সুবিধাসহ হাইটেক পার্ক বাস্তবায়নাধীন, * ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড/আইসিটি এক্সপো, * অনলাইনে জন্ম-মৃত্যুর নিবন্ধন, * রেলওয়ে টিকিটিং সিস্টেম, * অনলাইনে ভিসা প্রসেসিং ও যাচাই, * ইপিআই ও আইটিইই সার্টিফিকেশন, * জাতীয় ডেটা সেন্টার, * ডট বাংলা ডোমেইন চালুর উদ্যোগ, * ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ ক্যাপাসিটি ৬.৫ গুণ বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ, * প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবল বৃদ্ধি করে আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স অর্জন, * ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাইবার অপটিক ব্যাকবোন, * সকল সরকারি কর্মকর্তাদের মাঝে কম্পিউটার ট্যাবলেট বিতরণ, * শিক্ষার্থীদের মাঝে ল্যাপটপ কম্পিউটার বিতরণ, * সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াই-ফাই চালুর প্রক্রিয়া বাস্তবায়নাধীন, * ইউআইএসসি থেকে মোবাইল ব্যাংকিং চালুর উদ্যোগ, * প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সকল পাঠ্যপুস্তক নিয়ে ই-বুকের আনুষ্ঠানিক যাত্রা, * জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ই-ফাইলিং, * মুখস্থবিদ্যার প্রচলিত পাঠদান রীতির বদলে প্রযুক্তিনির্ভর সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি চালু, * তৃণমূলে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর বীমাসেবা চালুর উদ্যোগ, * জাতীয় ডিজিটাল উদ্ভাবনী পুরস্কার প্রবর্তন, * বিনিয়োগের জন্য অনলাইন রেজিস্ট্রেশন চালু, * বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলা চালু, * জাতীয় ওয়েবপোর্টাল চালু, * জাতীয় ই-তথ্যকোষ উদ্বোধন, * জেলা ওয়েবপোর্টাল চালু, * জেলা ই-সেবাকেন্দ্র চালু, * উপজেলা ওয়েবপোর্টাল চালু, * ইউনিয়ন তথ্য ও সেবাকেন্দ্র চালু, * বিমানের টিকিট ইউআইএসসির মাধ্যমে বিক্রয়ের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, * ইউনিয়ন ওয়েবপোর্টাল চালু, * অনলাইন জিডি ফিলিং, * বাংলাদেশ গর্ভমেন্টের সকল ফরম অনলাইনে, * একদিনে কোম্পানির রেজিস্ট্রেশন, * অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, * অনলাইনে এইচএসসিতে রেকর্ড সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি, * আয়কর রিটার্ন ফরম অনলাইনে, * অনলাইনে ড্রাইভিং লাইসেন্স, * অনলাইনে বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার তথ্য, * কৃষি তথ্য সার্ভিস, * পাসপোর্ট পরিসেবা, * পরিসেবার বিল পরিশোধ, * অনলাইনে হজের তথ্য, * ইলেক্ট্রনিক দরপত্র পদ্ধতি শুরু, * ডিজিটাল স্বাক্ষর পদ্ধতির প্রবর্তন, * বাংলাদেশ ডাক বিভাগের ই-সেবা, * মোবাইল ব্যাংকিং চালু।
আরও কিছু সহজসাধ্য উদ্যোগ
* কম্পিউটারভিত্তিক ভূমি ব্যবস্থাপনা, * ডেটাবেসের মাধ্যমে দুস্থ এবং বিধবা মহিলাদের ভাতা প্রদান বিষয়ক কর্মকা- পরিবীক্ষণ, * ওয়েবভিত্তিক চাকরি ব্যাংক, * ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নাগরিক হেল্প ডেস্ক, * এসএমএসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ফোন বিল পরিশোধ, * এসএমএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃক যাত্রীদের জন্য তথ্যসেবা প্রদান, * মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্যসমৃদ্ধ ডাটাবেস, * পারসোনাল ডাটাসিট (পিডিএস) অনলাইন প্রদর্শন এবং প্রিন্ট, * ইউনিয়ন পরিষদভিত্তিক তথ্যকেন্দ্র, কৃষি তথ্যকেন্দ্র, মৎস্য ও পশুসম্পদ তথ্যকেন্দ্র, * মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দুর্যোগ পূর্বাভাস সম্প্রচার, * উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ফোনে স্বাস্থ্যসেবা, * ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে শিক্ষক প্রশিক্ষণকে ফলপ্রসূ করা, * ক্লাস রুমে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের ব্যবহার।
বিভিন্ন ডিজিটাল অর্জন
* মন্থন অ্যাওয়ার্ড-২০১০, ৪টি ক্যাটাগরিতে পুরস্কৃত হলো বাংলাদেশ, * গার্টনারের প্রতিবেদন : শীর্ষ ৩০ আউটসোর্সিং দেশের তালিকায় বাংলাদেশ, * ই-পূর্জির সাফল্য ও স্বীকৃতি, * মেশিন রিডেবল পাসপোর্টের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি, * আইটিওর নির্বাচনে বিজয়ী বাংলাদেশ।
ই-গভর্নমেন্ট তালিকায় এগিয়েছে বাংলাদেশের অবস্থান
যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোতে ই-গভর্নমেন্ট কার্যক্রম দ্রুত প্রসার লাভ করছে। বিশ্বের ১৯৮ দেশের ই-গভর্নমেন্ট কার্যক্রমের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে বার্ষিক এই রিপোর্ট তৈরি করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের টাবম্যান সেন্টার ফর পাবলিক পলিসি বিভাগ। রিপোট অনুযায়ী ই-গভর্নমেন্টে প্রথম স্থানে রয়েছেÑ দক্ষিণ কোরিয়া, দ্বিতীয় তাইওয়ান, তৃতীয় সিঙ্গাপুর এবং চতুর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আগে দক্ষিণ কোরিয়ার স্থান ছিল ৮৬তম। তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে ৮৬ নম্বরে। আগে বাংলাদেশ ছিল ১১৫-তে।
পে-পল চালুর অপেক্ষায় বাংলাদেশ
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের কার্যকরী দিক-নির্দেশনা এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সফল প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট জুনায়েদ আহমেদ পলক এমপির পে-পলের ভাইস প্রেসিডেন্টের সাথে মিটিংয়ের মাধ্যমে কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণের ফলে পে-পল কর্তৃপক্ষ অল্প সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে তাদের জুম অপারেশন শুরু করবে। এই সফল উদ্যোগ অনলাইন আউট সোসিংয়ের মাধ্যমে অর্জিত আয়কে দেশে আনার প্রক্রিয়াকে সহজতর করবে।
পরিশেষে
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ পরিণত হয়েছে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোর মেরুদ- হিসেবে। বাংলাদেশে এর ব্যবহারও ধীরে ধীরে প্রসারিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রাকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে এ সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেওয়া হচ্ছে। দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসার ও বিকাশের জন্য যেমন প্রয়োজন দক্ষ জনবল, তেমনি দরকার প্রশিক্ষণ ও অর্থায়ন। তাই বাংলাদেশের সরকার হাতে নিয়েছে বেশ কিছু সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। তাই যথার্থ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রীর স্লোগানÑ ‘প্রযুক্তি প্রগতির পথ হিসাবে গণ্য, ডিজিটাল বাংলাদেশ হতে হবে সকলের জন্য’।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস